ওমকারেশ্বর দর্শন----
---------------------------- দেবাদিদেব মহাদেবের 12 জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম হলো বাবা ওমকারেশ্বর| বাবা ওমকারেশ্বর কে দর্শন করার আমার ইচ্ছা বহুদিনের| হঠাৎই সেই সুযোগ এসে গেল| নভেম্বর মাসে মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর গিয়েছিলাম আমার চোখের চিকিৎসার জন্য |তখনই পরিকল্পনা করে ফেলি ওমকারেশ্বর যাওয়ার| ইন্দোর থেকে ওমকারেশ্বর এর দূরত্ব মাত্র 80 কিমি |যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই সুন্দর |সরকারি-বেসরকারি প্রচুর বাস চলাচল করে আবার রেলপথ যাওয়া যায় |তবে রেল পথে গেলে একটু অসুবিধা ভোগ করতে হবে |রেলপথে গেলে নামতে হবে ওমকারেশ্বর রোড স্টেশন| সেখান থেকে মন্দিরের দূরত্ব 15 কিমি |আমার মতে পার্সোনাল গাড়িতে ওমকারেশ্বর যাওয়াই সবচেয়ে ভালো |এতে আপনি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন |আমরা একটি ছোট্ট গাড়ি ভাড়া নিলাম |ভাড়া নিল 2000 টাকা| সকাল সাড়ে আটটায় ডাইভার রামবাবু গাড়ি নিয়ে হাজির | এখানে সূর্যোদয় একটু দেরি করে হয় | যাই হোক সন করে আমরা সকাল নটার সময় যাত্রা শুরু করলাম ||সকালে যানজট কম থাকায় গাড়ির সুন্দর গতিতে এগিয়ে চলল| পনেরো-কুড়ি কিমি যাওয়ার পর গাড়ি বিন্দা পর্বত এর গাবে আস্তে আস্তে পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল |মাঝে মাঝে পড়ছে ভয়ানক সব পাহাড়ি বাক| বামবাবু নিখুঁতভাবে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে চলল| রাস্তার দু'পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মতো |কোথাও কোথাও রাস্তার পাশে গভীর খান| বিন্দা পর্বত মালার রূপ দেখার মত |যাওয়ার পথে পেলাম কয়েকটা পাহাড়ি গান |রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন| মানুষ খুব সচেতন এখানে| স্বচ্ছ ভারত অভিযানে ইন্দোর কেন প্রথম হয়েছে তা বুঝতে পারলাম |
ওমকারেশ্বর যখন পৌছালাম তখন বাজে 11:30 am. |নর্মদা নদী এখানে দুটি ভাগে বিভক্ত হয় একটি দ্বীপের সৃষ্টি করেছে যার নাম মান্ধাতা দ্বীপ | পুরান থেকে জানা যায় রামের পূর্বপুরুষ রাজা মান্ধাতা এখানে কঠোর তপস্যা করে শিবকে সন্তুষ্ট করেছিলেন| শিব সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিতে চাইলে রাজা মান্ধাতা নিজের মুক্তি, ও মহাদেব এইখানে চিরতরে বাস করার জন্য অনুরোধ করেন |সেই থেকে শিব এখানে জ্যোতি লিঙ্গ রূপে অবস্থান করছে| আর দ্বীপটি মাথাটা দিবে পরিচিতি লাভ করে |নর্মদা নদী এখানে ও কারের প্রবাহিত হয়েছে|
গোমতীঘাট থেকে তিন ভাবে ওমকারেশ্বর মন্দিরে যাওয়া যায় |বিশাল জুলন্ত সেতু দিয়ে | মামলেশ্বর সেতু নামে পরিচিত এছাড়া নদীপথে নৌকায় করে আর আছে একটি পাকা সেতু| ঝুলন্ত সেতু দিয়ে আমরা মন্দিরের পথে এগিয়ে গেলাম| রাস্তার দু'পাশে প্রচুর দোকানে পূজার সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে |বিক্রি হচ্ছে শিবের নানা পাথরের জ্যোতির্লিঙ্গ |জিনিসের দাম এখানে খুব বেশি নয় |তবে এখানে পুরোহিতদের খুব দৌরাত্ম্য| অনেকেই শিবের অভিষেক করার জন্য জোরাজুরি করে |নর্মদা নদীর জল দিয়ে বাবার অভিষেক করার জন্য যে যেমন পারে দ র হকে| কেউ 251 টাকা ,কেউ 501 টাকা ,আবার কেউবা হাজার এক টাকা দক্ষিণা নাই |এদের খপ্পরে না করাই ভালো |সবচেয়ে ভালো নিজে নর্মদা থেকে জল এনে বাবার মাথায় ঢাল| এতে মন পান তৃপ্ত হয় |কথিত আছে নর্মদা স্নান করে নর্মদা জল বাবার মাথায় ঢালে নাকি সব পাপ দূর হয় |যাইহোক আস্তে আস্তে আমরা মন্দিরে প্রবেশ করলাম |বিশেষ বিশেষ তিথিতে এখানে বিশাল ভিড় হয় |ঐদিন বীর বিশেষ ছিল না| বাবা ওংকারেশ্বর মন্দির টি তিনটি স্তরে বিভক্ত |নিচের স্তরে অধিষ্ঠান করছে বাবা ওমকারেশ্বর জ্যোতির্লিঙ্গ |গর্ভঘর বেশি বড় নয় |এখানে সরাসরি বাবার মাথায় জল ঢালা যায় না| বাবার জ্যোতির্লিঙ্গের পাশেই রয়েছে মা পার্বতীর মূর্তি| দ্বিতীয় তলা রয়েছেন বাবা মহাকাল, তৃতীয় তলায় বাবা সিদ্ধিনাথ, চতুর্থ তলায় বাবা গুপ্তেশ্বর ,আর পঞ্চম তলায় বাবা গজেরসর বিরাজ করেন| সকাল পাঁচটা থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত মন্দির খোলা থাকে| সকাল, দুপুর, রাতে... এই তিন বেলা বাবার পুজো আচ্ছা হয|় বিকেল চারটের সময় বাবার বিশেষ অঙ্গসজ্জা করা হয|় রাত্রিবেলায় বাবার জন্য বিশেষ বিছানা করা হয় | থাকে পাশা খেলার ব্যবস্থা| এখানকার মানুষের বিশ্বাস প্রতিদিন রাত্রিবেলা শিবদুর্গা এখানে পাশা খেলতে হাজির হন|
ওমকারেশ্বর মন্দিরের অপরদিকে গোমতী ঘাট এর কাছে অবস্থিত বাবা মামলেশ্বর এর মন্দির| ওমকারেশ্বর শিবের জ্যোতির্লিঙ্গ আর মামলেশ্বর হলো শিবের পার্থিব রূপ |বলা হয়ে থাকে মামলেশ্বর দর্শন না করলে ওংকারেশ্বর দর্শন পূর্ণ হয়না |বাবা মামলেশ্বর এর মন্দির টি সুবিশাল| মন্দির গায়ের কারুকার্য দেখার মত |মন্দির চত্বরে প্রচুর শিবলিঙ্গ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে দেখতে পেলাম| সেগুলি কি করে এলো তার সঠিক তথ্য জানতে পেলাম না| মান্ধাতা দ্বীপথেকে মাত্র দেড় কিমি দূরে কাবেরী নদী নর্মদা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে| এটি সঙ্গমস্থল নামে পরিচিত |পুরান থেকে জানা যায় মান্ধাতা দ্বীপে থাকার সময় কুবেরের সান এর জন্য মহাদেব নিজের জটা থেকে কাবেরী নদী কে সৃষ্টি করেছেন |এই সঙ্গমের জল খুবই পবিত্র |এখনকার জলে পাথরের উপর পাথর চাপিয়ে মানত করলে নাকি ঘর বাড়ির স্বপ্ন পূরণ হয়| মান্ধাতা দ্বীপে অপর দর্শনীয় স্থান হল বাবা সিদ্ধ নাথের মন্দির. এটি সিদ্ধেশ্বর মন্দির নামে পরিচিত. একে আদি ওমকারেশ্বর ও বলা হয়ে থাকে .ওমকারেশ্বর মন্দির থেকে আড়াইশো বেশি সিরি চেপে এখানে পৌঁছাতে হয় |.বাস্তুশাস্ত্র অসাধারণ নিদর্শন এই মন্দির .lমন্দিরের কারুকার্য সত্যিই দেখার মতো| এখান থেকে নর্মদা নদী রূপ দেখার মত. |এই দ্বীপে আছে কেদারেশ্বর মন্দির, গায়ত্রী মন্দির , গজানন গনেশের মন্দির. ওমকারেশ্বর মন্দির এর কাছে আছে গৌরি সোমনাথের মন্দির | ওমকারেশ্বর থেকে দূরত্ব মাত্র 5 কিমি |এখানে শিব লিঙ্গ 6ft লম্বাএবং কালো বর্ণের| এই মন্দির খুব জাগ্রত এবং এখানেও প্রচুর ভক্ত সমাগম হয় | ওমকারেশ্বর থেকে মাত্র 6 km দূরে আছে সাত মাতৃকা দেবীর মন্দির.এখানে সাত দেবী একসাথে আরাধনা করা হয়| মহেশ্বরী, চন্ডিকা ,নরসিমা ,কুমারী ,ইন্দ্রানী, ভৈরবী আর ব্রাহ্মণী এখানে একসাথে পূজিত হন. ওমকারেশ্বর মন্দির থেকে মাত্র 8 কিমি দূরে রয়েছে অসাধারণ সৌন্দর্যের নিদর্শন কাজল রানি গুহা| আকর্ষণীয় tourist spot এটি.| ওমকারেশ্বর মন্দিরের খুব কাছেই নর্মদা নদীর উপর বাঁধ দেয়া হয়েছে |এই বাঁধ দেখার মত|
ওমকারেশ্বর মন্দির দুপুরে প্রসাদ গ্রহণের ব্যবস্থা আছে| এখানে আছে মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের নর্মদা রিসোর্ট |আছে নানা বাজেটের বিভিন্ন হোটেল| এখানে আছে প্রচুর ধর্মশালা| ইন্দোর ফেরার পথে দেখতে পেলাম শনি মহারাজের এক বিশাল মন্দির |শনি মহারাজের এত বড় মন্দির আগে কখনো দেখিনি |মন্দির দর্শন করে আবার আমরা রওনা হলাম |শহরে পৌছাতে পৌছাতে বেলা গড়িয়ে গেল | ওমকারেশ্বর দর্শন আমার জীবনের এক বিরাট অভিজ্ঞতা
0 মন্তব্যসমূহ