Ticker

6/recent/ticker-posts

Advertisement

Responsive Advertisement

হেতমপুর রাজবাড়ী - এক ইতিহাসের সাক্ষী

 



হেতমপুর রাজবাড়ী - এক ইতিহাসের সাক্ষী .


 হেতমপুর রাজবাড়ি এক প্রাচীন ইতিহাসের ইতিবৃত্ত আজও বহন করে চলেছে. সময় এগিয়ে চলে আপন তালে কিন্তু হেতমপুর রাজবাড়ী মহিমা আজও কোনোভাবেই মলিন  হয়নি. স্বমহিমায় নিজের ইতিহাস আজও আমাদের জানিয়ে চলছে . রাজবাড়ী , প্রাচীন মন্দির  বা প্রাচীন অট্টালিকা দেখার আলাদা আকর্ষণ থাকে. রাজবাড়ির ইট , কাঠ , পাথর, করি বর্গা তৈলচিত্র , আসবাবপত্র সব কিছুই যেন ইতিহাসের কথা বলে.



এমনই এক ইতিহাস মন্ডিত রাজবাড়ী দেখার টানে বেরিয়ে পড়লাম হেতমপুরের উদ্দেশ্যে . ট্রেনে করে পৌঁছে গেলাম বর্ধমান. সেখান থেকে বোলপুর. বোলপুর থেকে হেতমপুরের দূরত্ব মাত্র 45 কিমি . ঘন্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হেতমপুর.


স্থানীয় মানুষদের জিজ্ঞেস করে পৌঁছে গেলাম হেতমপুর রাজবাড়ী সামনে. রাজবাড়ীর সিংহ দুয়ারের সামনে এসে দাড়ালাম. সিংহদুয়ার এর গঠনশৈলী সত্যিই দেখার মতো. সিংহদ্বারের অসাধারণ শিল্প নৈপুণ্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়. রাজবাড়ীর গেট টি লাল মাটি দিয়ে তৈরি. এর দু'পাশের অংশের চেয়ে মাঝের অংশটি উঁচু. মাঝের উচু অংশে রয়েছে বিশাল আকৃতির একটি ঘড়ি. যদিও সেই ঘড়ির কাঁটা বহু আগেই থেমে গেছে. স্থানীয় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক এর কাছে জানতে পারলাম রাজবাড়ির প্রাচীন ঐতিহ্যময় ইতিহাস. হেতমপুর রাজবংশ  প্রতিষ্ঠাতা রাধানাথ চক্রবর্তী. যিনি প্রথম জীবনে সামান্য একজন গোমস্তা ছিলেন. পূর্বতন রাজনগরের রাজবংশের রাজাদের দমন করে তিনি ক্ষমতা দখল করেন.1781 সাল থেকে 1791 সালের মধ্যে তিনি 19 টি মৌজা দখল করেন. শোনা যায় তিনি নাকি মুর্শিদাবাদের নবাবের কাছ থেকেও কিছু মৌজা ও জমিদারি ক্রয়  করেছিলেন. তৎকালীন বৃটিশ সরকারের কাছ থেকে তিনি "মহারাজা" উপাধি লাভ করেন.1838 সালে তিনি মারা যান . এই রাজবংশের আরেক প্রভাবশালী রাজা ছিলেন রামরঞ্জন চক্রবর্তী.1874 সালে দুর্ভিক্ষের সময় তিনি নানাভাবে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য করেন. ফলস্বরূপ তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে "রাজা বাহাদুর" উপাধি লাভ করেন. তার  আমলে  রাজবাড়ী বিশাল অংশ নির্মিত হয়েছিল. এটি "রঞ্জন প্যালেস" নামে পরিচিত. 1905 সালে নতুন রাজবাড়ী নির্মাণের কাজ শেষ হয়. রাজবাড়ীর গঠনশৈলী সত্যিই মনমুগ্ধকর. রাজবাড়ী টি টুইন প্যালেস অর্থাৎ ডানদিক বাঁদিক দুদিকেই একই রকম দেখতে. এরকম ভাবেই রাজবাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে. দ্বিতল রাজবাড়ী টির সামনের দিকে বিশাল বিশাল পিলার রীতিমত অবাক করে. এই রাজবাড়ীতে আছে 999 টি সেগুন কাঠের তৈরি দরজা. শোনা যায় মুর্শিদাবাদের সম্মানে এখানে হাজারদুয়ারি থেকে একটি দরজা কম বানানো হয়. এই জন্য এই রাজবাড়ী কে "হেতমপুর  হাজারদুয়ারি" ও বলা হয়ে থাকে.


খানিকটা হেঁটে পৌঁছে গেলাম মূল রাজ বাড়ির সামনে. সুদীর্ঘ স্তম্ভের উপর সগৌরবে নিজের শেষ অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে এই রাজবাড়ী. রাজবাড়ীর একটি অংশে ডিএভি পাবলিক স্কুল তৈরি হয়েছে. সেই স্কুলের ভিতরে সারি সারি ঘর আর সামনে বিশাল মাঠ. এক সময় কত জৌলুস আর আভিজাত্য ই না ছিল এখানে. জলসাঘরে বসত  নাচ-গানের আসর. আতরের গন্ধে ও রঙিন বাতির আলোয় চারদিক ভরে উঠত.


পুজোর সময় নট্ট কোম্পানির যাত্রা পালার আয়োজন করা হতো রাজবাড়ীতে. শোনা যায় পূজোর সময় নাকি রাজ বাড়ির সামনে বিশাল মেলা বসতো. আশেপাশের গ্রামের মানুষ রাজবাড়ীতে ভিড় জমাতো.


ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে হেতমপুর রাজবাড়ী যথেষ্ট অবদান রয়েছে. বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম আর চারণ কবি মুকুন্দ দাস ব্রিটিশদের নজর এড়াতে এই রাজবাড়ীতে আশ্রয় নিয়েছিলেন. রাজবাড়ীর দোতলার একটি ঘরে তারা আশ্রয় নিয়েছিলেন . যদিও শেষ রক্ষা হয়নি. নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের ধরা পড়ে কারাগারে বন্দি হন. বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীর গোপন আস্তানা ছিল এই রাজবাড়ী. বহু অফিসারের হত্যার নকশা রচিত হয়েছিল এই রাজবাড়ীতে. 1947 সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন রাজা বিশ্ব রঞ্জন চক্রবতী বীরভূম জেলার প্রথম পতাকা উত্তোলন করে এই রাজবাড়ী থেকেই.


এবার ফেরার পালা. ফেরার পথে দেড়শ বছরের পুরনো একটি শিব মন্দির দেখতে পেলাম .মন্দিরটির গায়ে টেরাকোটার কাজ ও নির্মাণশৈলী সত্যিই দেখার মতো. প্রাচীন ইতিহাস পিছনে ফেলে এগিয়ে চললাম বাড়ির উদ্দেশ্যে.


কিভাবে যাবেন - - হাওড়া থেকে ট্রেনে দুবরাজপুর স্টেশনে নামতে হবে. দুবরাজপুর থেকে হেতমপুর মাত্র 3/4 কিলোমিটার. টোটো ু বা অটোয় করে যাওয়া যায়. এছাড়া সিউড়ি থেকে যেকোনো বাসে করে সরাসরি হেতমপুর যাওয়া যায়. বাঁকুড়া , পুরুলিয়া, আসানসোল , দুর্গাপুর সব জায়গা থেকেই এই রুটে বাস পাওয়া যায়.  সিউড়ি থেকে অজস্র বাস ছাড়ে হেতমপুর এর উদ্দেশ্যে. বোলপুর থেকে ট্রেনে বা বাসে করে ও হেতমপুর পৌঁছানো যায়.


কোথায় থাকবেন-- হেতমপুরের থাকার তেমন ব্যবস্থা নেই. হেতমপুর থেকে তিন চার কিমি দূরে দুবরাজপুরে প্রচুর ছোট -বড় হোটেল -লজ আছে থাকা খাওয়ার জন্য. এছাড়া বোলপুর ও সিউড়িতে ও থাকা যায়.

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ