“বাবা হাতিখেদার দর্শনের”
“জয় বাবা হাতিখেদার জয়”-- নামটি শুনে কেমন অদ্ভুত বলে মনে হচ্ছে না? এ কেমন দেবতার নাম? আমরা , ওংকারেশ্বর, ষাঁড়েশ্বর, মহাকাল, মা সন্তোষী, শ্রীকৃষ্ণ, রাধামাধব প্রভৃতি দেবদেবীর নাম শুনেছি কিন্তু বাবা হাতিখেদা নামটি বড়ই অদ্ভুত. বাবা হাতিখেদা ঝাড়খন্ড ও পশ্চিমবঙ্গের মানভূম অঞ্চলের খুবই জাগ্রত দেবতা. এখানকার মানুষের মনে বাবার প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তি অগাধ. বাবা হাতিখেদার কথা আগে এক আত্মীয় মারফত শুনেছিলাম. বাবার স্থানে যাবার একটি সুপ্ত বাসনা ছিল. গত বছর কালিপুজোর সময় আমার সেই সুপ্ত বাসনা পূর্ণ হয়.
পরিবারের সকলে মিলে কালিপুজোর সময় মামা বাড়ি পুরুলিয়া গিয়েছিলাম. হঠাৎ ভাইফোঁটার দিন ঠিক হলো সকলে মিলে রবিবার বাবা হাতিখেদার মন্দিরে যাওয়া হবে পুজো দিতে.
রবিবার সকাল আটটায় আমাদের ও মামাবাড়ি মিলিয়ে সাত জন সদস্য একটি বুলেরো গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম বাবা হাতিখেদা উদ্দেশ্যে. বরাবাজার পর্যন্ত রাস্তা খুবই ভালো কিন্তু তারপরে রাস্তা খুবই খারাপ. মন্দির পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার রাস্তা খুবই খারাপ. হাতিখেদা মন্দির ঝাড়খন্ড এর লাউছড়া গ্রামে অবস্থিত. পুরুলিয়া থেকে মন্দিরের দূরত্ব মাত্র 46 কিমি. কিন্তু রাস্তা খারাপ হওয়ায় আমাদের যেতে আড়াই ঘন্টা সময় লাগলো. মন্দির পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল.
বাবা হাতিখেদা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দেবতা. স্থানীয় মানুষের কাছ থেকে এই মন্দির নির্মাণের ইতিবৃত্ত জানা গেল. আগে প্রায় হাতির দল জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে এখানকার বসবাসকারী আদিবাসী মানুষের ফসলের ক্ষেত ও ঘরবাড়ি ক্ষতি করত. হাতির উপদ্রব এ মানুষের জীবন হয়ে উঠে অতিষ্ঠ. হাতির উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্য এখানকার মানুষ হাতিখেদা ঠাকুরের পুজো শুরু করে. জনশ্রুতি পুজো চালু হবার পর আর হাতির দল এখানে কোনদিন আসেনি. হাতিখেদা ঠাকুর খুবই জাগ্রত. এই মন্দিরের রীতি হলো ভক্তরা মানত করে গাছে নারকেল বেঁধে জান. মনোবাসনা পূর্ণ হলে সেই নারকেল আপনাআপনি গাছ থেকে খসে পড়ে. মনোবাসনা পূর্ণ হলে মন্দিরে ভেড়া বলি দিতে হয়. তারপর মন্দিরের সেই ভেড়ার মাংস রান্না করে খেতে হয়. মন্দিরের পিছনে রান্না করার ব্যবস্থা আছে. তবে মহিলারা সেই মাংস খেতে পারেনা. হাতিখেদা মন্দির এর প্রধান প্রসাদ হল নারকেল.
মন্দিরের বাইরে প্রচুর পূজা সামগ্রীর দোকান আছে. আমরা একটি দোকান থেকে পুজোর ডালি কিনে মন্দিরে প্রবেশ করলাম. পুজোর লাইনে প্রচুর ভিড় হওয়াই পুজো দিতে আমাদের বেশকিছু সময় লাগলো. অনেকটা জায়গা নিয়ে হাতিখেদা মন্দির তৈরি করা হয়েছে. মন্দিরের পরিবেশ বেশ সুন্দর ও সাজানো গোছানো. এই মন্দিরে এলে আপনার মন শান্তিতে ভরে উঠবে. মন্দিরের বাইরে রাস্তার দুই পাশে রয়েছে প্রচুর দোকান. সেখানে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি হয় . আছে প্রচুর খাবারের দোকান. পুজো আচ্ছা দিয়ে , একটু ঘোরাঘুরি করে দুপুরের খাবার একটি দোকানে করলাম. বিকেল চারটের সময় আমরা গাড়ি ছাড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে.
কাছাকাছি কয়েকটি দর্শনীয় স্থান.... বাবা হাতিখেদা মন্দির এর কাছাকাছি অনেকগুলি দর্শনীয় স্থান রয়েছে. সকাল সকাল পুজো দিতে পারলে এই স্থানগুলি ঘুরে দেখতে পারেন...
ডিমনা লেক/ড্যাম ....1940 সালে টাটা কোম্পানি দ্বারা এই লেকটি বানানো হয়. এখানকার জলকে পরিশুদ্ধ করে সমগ্র জামশেদপুর শহরে পরিবেশন করা হয়. এই ড্যাম এ সাতটি লক গেট রয়েছে. দলমা পাহাড়ের নীচে তৈরি হওয়া এই লেকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই অসাধারণ. এখানে থাকার জন্য 1টি রিসোর্ট আছে. হাতিখেদা মন্দির থেকে এর দূরত্ব মাত্র 23 কিমি.
দলমা অভয়ারণ্য... হাতিখেদা মন্দির থেকে মাত্র 30 কিমি দূরে NH33 এর পাশে বিশাল এরিয়া জুড়ে গড়ে উঠেছে ডিমনা অভয়ারণ্য. এটি হাতিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র. এখানে হাতি ছাড়াও হরিণ, বন শুয়োর, বনমুরগী, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি দেখতে পাবেন.
চান্ডিল ড্যাম..... হাতিখেদা মন্দির থেকে চান্ডিল ড্যামের দূরত্ব মাত্র 36 কিমি. সুবর্ণরেখা নদীর উপর এই ড্যাম বানানো হয়েছে.ড্যামের বিশাল জলরাশির মাঝে ছোট ছোট টিলা গুলি এক অসাধারণ দৃশ্য সৃষ্টি করে. দলমা পাহাড়ের নীচে গড়ে ওঠা এই ড্যামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অসাধারণ.
কখন যাবেন..... পুরুলিয়া ও ঝাড়খন্ড ছোটনাগপুর মালভূমির অন্তর্ভুক্ত , এই কারণে গ্রীষ্মকালে এখানে প্রচন্ড গরম পড়ে. তাই গ্রীষ্মকালে এখানে না আসাই ভাল. আবার শীতকালে প্রচন্ড ঠান্ডা পরে. এখানে আসার সবচেয়ে ভালো সময় অক্টোবর থেকে মার্চ মাস.
কিভাবে যাবেন.... কলকাতা থেকে বাবা হাতিখেদা ঠাকুরের মন্দিরে আসতে চাইলে সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ট্রেন. হাওড়া- চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেনে পুরুলিয়া স্টেশন এ নেমে পড়ুন. সকাল ছটায় পুরুলিয়া স্টেশনে ট্রেন টি পৌঁছায়. স্টেশনের কাছাকাছি প্রচুর নামি দামি হোটেল ও লজ আছে. ঐদিন পুরুলিয়া শহরটি ঘুরে দেখতে পারেন. এখানকার দর্শনীয় স্থানগুলি হল সুরুলিয়া মিনি চিড়িয়াখানা, সাহেব বাঁধ, সায়েন্স মিউজিয়াম, সুভাষ পার্ক. পরের দিন সকাল সকাল স্নান করে ভাড়া গাড়িতে বেরিয়ে পড়ুন বাবা হাতিখেদা মন্দির এর উদ্দেশ্যে. গাড়ি ভাড়া পড়বে 2000 -2500 টাকা. সন্ধ্যাবেলায় হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে শহরটি ঘুরে দেখতে পারেন. যেতে পারেন কাঁসাই নদীর ধারে. টোটো ভাড়া নিবে জন পতি কুড়ি টাকা. এখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ আপনার ভালো লাগবে. হাতে দু তিনদিন সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন অযোধ্যা পাহাড় ও বড়ন্তি ড্যাম.
কোথায় থাকবেন.... হাতিখেদা মন্দির যাওয়ার সবচেয়ে ভাল হল পুরুলিয়া শহরে থাকা. নামিদামি ছোট-বড় অনেক হোটেল লজ আছে. এছাড়া জামশেদপুর হয়েও যাওয়া যায়. সেক্ষেত্রে আপনাকে থাকতে হবে জামশেদপুর শহরে.
অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লেখা-----
1) ইতিহাস ও ধর্মের অসাধারণ মেলবন্ধন: উজ্জয়িনী.click Here 👉https://worldvraman.blogspot.com/2022/08/ujjain.html
2) উড়িষ্যার কাশ্মীর দারিংবাড়ি....https://worldvraman.blogspot.com/2022/01/daringbadi.html
3) পাখিদের স্বর্গরাজ্য চুপির চর....https://worldvraman.blogspot.com/2021/11/chupir-char-purbasthali.html
0 মন্তব্যসমূহ