বকখালির সমুদ্র সৈকতে একদিন
দীঘার জনপ্রিয়তা আজ আকাশছোঁয়া হাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন সমুদ্র সৈকত বকখালি আজ অনেকটাই জৌলুসহীন .আজ থেকে বহু বছর আগে বকখালি ছিল দীঘা তুলনায় বেশি জনপ্রিয়. তখন দীঘা যাবার একমাত্র মাধ্যম ছিল বাস বা পর্যটকদের প্রাইভেট গাড়ি. সে তুলনায় বকখালি যাওয়া অনেকটাই কলকাতা বা তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মানুষের কাছে সহজসাধ্য ছিল . কিন্তু দীঘা পর্যন্ত ট্রেন পরিষেবা চালু হাওয়ার ফলে ছবিটা পুরোপুরি পাল্টে যায়. আজ বকখালি তুলনায় দীঘা বেশি জনপ্রিয়. সারা বছর প্রচুর পর্যটক সমাগম .দিঘার উপকূল পর্যটকের ভিড়ে জমজমাট থাকে সারা বছর. কর সে তুলনায় বকখালি অনেক নিরিবিলি শান্ত. যাদের ভিড়ভাট্টা পছন্দ নয় অথচ সমুদ্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান তাদের আজও প্রথম পছন্দ বকখালি. সুন্দরবন লাগোয়া বকখালি সমুদ্র সৈকতের সৌন্দর্য অন্যদের চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন. দীঘা তুলনায় বকখালি সমুদ্র অনেকটাই শান্ত.
সময় পেলেই অনেকবার ছুটে গেছি দীঘায়. এবার তাই পুজোর ছুটিতে ঠিক করলাম বকখালি যাবার , একদিনের সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে. করোনার প্রাদুর্ভাব অনেকটাই কমে যাওয়ায় সরকার পর্যটন কেন্দ্র গুলি আগেই খুলে দিয়েছিল. ফলে যাবার তেমন কোনো বাধা ছিল না . শনিবার রাতে বেরিয়ে পড়ার পরিকল্পনা করলাম. নির্দিষ্ট দিন রাত্রি বেলায় একটি বুলেরো গাড়িতে 6 - 7 জন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম. আশ্বিন মাসের শেষ .রাতের দিকে হালকা হালকা শীত শীত ভাব .অল্প অল্প হিম পড়ছে .রাত্রি নটার সময় আমরা গাড়ী ছাড়লাম . ড্রাইভার দাদার কথামতো আমরা মেদিনীপুর হয়ে যাবার পরিকল্পনা করলাম, এটি নাকি শর্টকাট রাস্তা. সময় কম লাগে আর রাস্তাও ভালো. ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে আমরা মেদিনীপুর পৌঁছে গেলাম .বাইপাসের ধারে একটি লাইন হোটেলে সাময়িক বিরতি নিলাম . কয়েকজন কফি খেলাম আমার . আবার পথ চলা হল শুরু. ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে গাড়ি ছুটে চলেছে. হালকা সুরের হিন্দি গান বাজছে. রাত বাড়ার সাথে সাথে অনেকের চোখ ঘুমে বুঝে আসতে লাগলো .আমি ড্রাইভার দাদার পাশে বসে ছিলাম. গান শুনতে শুনতে চলেছি . রাত জাগা আমার অভ্যেস আছে. ড্রাইভার এর পাশে বসে ঘুমিয়ে পড়লে ড্রাইভারও ঝিমিয়ে পড়তে পারে. এতে বিপদ ঘটতে পারে. তাই ডাইভারের পাশে বসে ঘুমানো কখনই উচিত নয়. যাই হোক কোলাঘাট ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে. ডায়মন্ড হারবার যখন পৌঁছলাম তখন ভোররাত. বাইপাসের ধারে একটি হোটেলে চা খেলাম .একটু ফেস হয়ে নিলাম.
সমুদ্রে সূর্যোদয়ের দৃশ্য অসাধারণ দৃশ্য দীঘায় হোক বা বকখালি সর্বত্রই এই দৃশ্যে চোখ জুড়িয়ে যায় .সমুদ্রের বুক থেকে জলরাশি চিরে লাল টকটকে সূর্যদেবের উদয় এক কথায় অসাধারণ. সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে বহু মানুষ সমুদ্র সৈকতে ভিড় জমিয়েছে. সমুদ্র সৈকতে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে দোকানে গরম গরম 1 কাপ চা খেলাম . ভাটা থাকায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে জলের দর্শন পেলাম. সমুদ্রের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাসে বেশ ভালই লাগছিল. সৈকতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে একটা হোটেলে হালকা করে টিফিন সেরে নিলাম. সমুদ্রের ধারে একটা সস্তা হোটেলে একটি রুম ভাড়া নিয়েছিলাম. সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম. সারারাত জেগে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম একটু বিশ্রাম নিতে শরীর-মন তাজা হয়ে উঠল. এবার বন্ধুরা মিলে বেরিয়ে পড়লাম সমুদ্রস্নানের উদ্দেশ্যে. সমুদ্রে কিছুক্ষণ জলকেলি করে সময় কাটালাম. সমুদ্রে স্নান করতে নামলে উঠতে মন চায় না .সময়ের অভাবে বাধ্য হয়ে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সমুদ্র থেকে উঠতে হলো .রুমে ফিরে ভালো করে স্নান করে ফ্রেস হয়ে নিলাম. না হলে সমুদ্রের নোনা জলে নুন গায়ে ফুটে থাকবে. এরপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম হেনরি দ্বীপের উদ্দেশ্যে .রাস্তার একপাশে গ্রাম্য ঘরবাড়ি, গাছপালা আর অন্যদিকে ম্যানগ্রোভ জঙ্গল . হেনরি দ্বীপের দূরত্ব বেশি নয় মাত্র 4 কিমি. কিছুক্ষণের মধ্যে হেনরি দ্বীপে পৌঁছে গেলাম. স্থানীয় এক ভদ্রলোক জানালেন মৎস্য মন্ত্রী কিরণময় নন্দ এই দ্বীপকে সাজিয়েছিলেন. এখানকার সবকিছুই তিনি করেছেন তার উদ্যোগে এই দ্বীপটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে. এখানে প্রচুর সুন্দরী গাছ দেখতে পেলাম. বই এর পাতায় সুন্দরী গাছের কথা পড়েছিলাম, স্বচক্ষে তা উপর থেকে দেখতে পেলাম .এই দ্বীপে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে .তার উপর থেকে সমগ্র দ্বীপকে অসাধারণ দেখতে লাগে.
হেনরি দ্বীপ থেকে এবার আমরা গেলাম কারগিল সি বিচ. আইলা ঘূর্ণিঝড়ে এই দ্বীপটি প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল .ঘরবাড়ি সমুদ্র গর্ভে হারিয়ে গেছে .প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রসের চিহ্ন আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিকে-সেদিকে. বিচের অনেকটাই শক্ত চর হয়ে গেছে .বাচ্চাদের দেখলাম সেখানে ক্রিকেট খেলছে .এবার আমরা গেলাম ফ্রেজারগঞ্জ. একসময় এখানে ফেজার সাহেবের কুঠি ছিল. কিন্তু সমুদ্রের গর্ভে তা আজ হারিয়ে গেছে. ফ্রেজারগঞ্জ এ বায়ুচালিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কতগুলি বায়ু কল বসানো হয়েছিল কিন্তু সেগুলি আজ অকেজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে .
কিভাবে যাবেন ---:- রেলপথ ও সড়ক পথে খুব সহজেই বকখালি যাওয়া যায়. বকখালি ব্রিজ তৈরী হওয়ার ফলে সড়ক পথের যোগাযোগ খুবই ভাল হয়েছে .আগে ভেসেল করে নদী পথ পেরিয়ে বকখালি যেতে হতো কিন্তু এখন বকখালি ব্রিজ তৈরী হওয়ার সরাসরি বকখালি যাওয়া যায়. ধর্মতলা থেকে বকখালি যাওয়ার বাস পাওয়া যায় ভাড়া 40 থেকে 45 টাকা. ট্রেনে যেতে হলে শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরতে হবে, নামতে হবে নামখানা স্টেশন. বাস বা টোটো তে করে বকখালি যাওয়া যায় . সাইট সীনের জন্য টোটো ভাড়া করতে পারেন.
কোথায় থাকবেন ---- পশ্চিমবঙ্গের সৈকত গুলির মধ্যে বকখালি অন্যতম জনপ্রিয়. পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ থেকেও বহু পর্যটক বকখালি বেড়াতে আসেন. দু এক দিনের ছুটিতে বকখালি সুন্দরবন বেড়াতে যান. এখানে থাকার জন্য সৈকত এর কাছাকাছি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বকখালি টুরিস্ট লজ রয়েছে. রিসোর্ট টি খুবই সুন্দর .500 টাকা থেকে এখানে রুম পেয়ে যাবেন. এখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে. দাম একটু বেশি হলেও খাবারের গুণগত মান খুবই ভালো .এছাড়া বেসরকারি অনেক লজ হোটেল রয়েছে উল্লেখযোগ্য হোটেল হল...1) হোটেল ডলফিন,2) হোটেল অমরাবতী,3) হোটেল পোর্টল্যান্ড,4) স্টারইন রিসোর্ট,5) হোটেল ইস্ট কোস্ট
0 মন্তব্যসমূহ