Ticker

6/recent/ticker-posts

Advertisement

Responsive Advertisement

ইতিহাস ও ধর্মের অসাধারণ মেলবন্ধন: উজ্জয়নী(Ujjain)

 ইতিহাস ও ধর্মের অসাধারণ মেলবন্ধন: উজ্জয়নী

এ বছর  মার্চের শেষে  ইন্দোর গিয়েছিলাম চোখের ট্রিটমেন্টের জন্য. সমস্ত পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ডাক্তার দেখানোর পর হাতে একদিন সময় থাকায় ভাবলাম ফালতু ফালতু রুমে বসে সময় কাটানোর চেয়ে সামনাসামনি কোথাও ঘুরে এলে কেমন হয়. যেমন ভাবা তেমনি কাজ. ঠিক করলাম পবিত্র ভূমি মহাকালেশ্বর দর্শন করতে যাব. পূর্ণ অর্জনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক উজ্জয়নী শহরের ঐতিহাসিক নিদর্শন গুলি ও ঘুরে দেখা যাবে. ইতিহাসের পাতায় উজ্জয়িনীর কথা পড়েছি. মৌর্য সম্রাট বিক্রমাদিত্য ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালের নানা নিদর্শন এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে. এক সময় ভারতের ইতিহাসে উজ্জয়নী ছিল এক উল্লেখযোগ্য রাজ্য. কত ঐতিহাসিক' ঘটনাপ্রবাহের সাক্ষী এই উজ্জয়নী শহর. তবে আজ উজ্জয়নী বিশ্ব প্রসিদ্ধ তৃতীয় জ্যোতির্লিঙ্গ মহাকাল মন্দির এর জন্য. ইতিহাস ও আধ্যাত্বিক সমৃদ্ধ সেই উজ্জয়িনী যাব ভেবে বেশ রোমাঞ্চ  লাগছিল. যাইহোক বিকেলে পূর্ব পরিচিত এক ট্রাভেল এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে দর দাম ঠিক করলাম. ভাড়া ঠিক হল আড়াই হাজার টাকা(2500).


পরের দিন অর্থাৎ শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়লাম. ইন্দরে সূর্যাস্ত যেমন দেরি করে হয় তেমনি সূর্যদয়ো একটু দেরি করে হয়. সকাল 6:30 তেও ভালো করে আলো ফুটে না. স্নানটান সেরে সকাল নটার মধ্যে বেরিয়ে পড়লাম মহাকালেশ্বর এর উদ্দেশ্যে. মহাকালের পুজো দেওয়ার ইচ্ছে ছিল, তাই সকালে কিছু খেলাম না. সকলেই উপস দিলাম. ইন্দোর থেকে উজ্জয়িনী দূরত্ব মাত্র 55 কিমি ইন্দোর শহরের রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন .রাস্তায় নেই কোন গর্ত, খুবই মসৃন রাস্তা. দক্ষ ড্রাইভার রবিদা এমন গাড়ি চালাছিলেন যে, জার্নি কিছু বোঝাই গেল না. কখন যে উজ্জয়নী শহরে পৌঁছে গেছি বোঝাই গেল না. মার্চের শেষ হলেও এখানে গরম কিন্তু প্রচন্ড. উজ্জয়নী শহর প্রবেশের মুখে রয়েছে বিশাল এক প্রবেশ তোরণ.প্রবেশ তোরণ টি দেখতে সত্যিই অসাধারণ. শহরে ঢোকার মুখে রাস্তার দু'পাশে হোটেল ও লজ দেখতে পেলাম. উজ্জয়িনী জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পট বলে সারাবছর এখানে প্রচুর পর্যটক ঘুরতে আসেন. এখানকার হোটেল লজ গুলি সারা বছরই ভর্তি থাকে. সারাবছরই উজ্জয়নী শহর থাকে জমজমাট.


মহাকালেশ্বর মন্দির... প্রথমে আমরা গেলাম মহাকালেশ্বর. বাবা মহাকালের মন্দিরে যখন পৌছালাম, তখন বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে. মন্দিরের সামনে গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা নেই. মন্দির থেকে একটু দূরে গাড়ি পার্কিং করতে হলো .সামনেই এক মহিলা থেকে পুজোর ডালি কিনে মন্দির দিকে এগিয়ে চললাম .মন্দিরের সামনে গিয়ে দেখি বিশাল ভিড়. ভাবলাম ফাঁকা সময় যদি এত ভিড় হয় তাহলে বিশেষ বিশেষ তিথিতে কি ভিটায় না এখানে হয়. মন্দিরে প্রবেশের দুটি রাস্তা. আপনি যদি ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে তাড়াতাড়ি মন্দিরে প্রবেশ করতে চান তাহলে আড়াইশো টাকার টিকিট কাটতে হবে. না হলে বিনামূল্যের সাধারণ ভক্তদের সাথে লাইন দিতে হবে. বাবার মন্দির ও দেখছি এক ধরনের ব্যবসা শুরু হয়েছে. যাই হোক আমরা বিনামূল্যের লাইনে দাড়িয়ে পড়লাম. বিশাল লাইন কিন্তু কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা বা ঠেলাঠেলি নেই. আমাদের এখানে এই রকম দৃশ্য কল্পনা করাও দুঃসাধ্য. খুব সুন্দর ভাবে লাইন এগিয়ে  যেতে লাগলো ধীরেসুস্থে. সূর্যের তাপে মন্দির চত্বর তেতে আগুন. খালি পায়ে দাঁড়ানো খুবই কষ্টকর. তবে বাঁচোয়া যে মন্দির চত্বরে মোটা কার্পেট বিছানো রয়েছে. এতে গরম কম লাগছে. মাথার উপরে টাঙ্গানো রয়েছে কাপড়ের সামিয়ানা. প্রায় এক ঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম.  মন্দিরের ভিতরেও প্রচুর মানুষের ভিড়. মন্দিরের ভিতরে ছবি তোলা নিষেধ. পুজো দিয়ে বাবার দর্শন করে বেরিয়ে এলাম. মনের মধ্যে এক আশ্চর্য অনুভুতি হতে লাগলো. মহাকাল মন্দির এর প্রধান আকর্ষণ ভস্ম আরতি  . প্রতিদিন ভোর চারটের সময় মহাকালের শিবলিঙ্গ কে চিতাভস্ম দিয়ে সাজিয়ে আরতী করা হয়. অবশ্যই আরতী দেখার জন্য  দু'একদিন আগে থেকে টিকিট বুক করে রাখতে হয়. মহাকাল মন্দির এর আয়তন বিশাল. বিশাল এলাকাজুড়ে মহাকালের মন্দির নির্মিত হয়েছে. মন্দির চত্বরে রয়েছে একটি অতিথিশালা.  সমগ্র মন্দির  ঘুরে দেখতে প্রচুর সময় লাগলো . ঘুরতে ঘুরতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম. একটি গাছের তলায় একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম. মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে গেল. এখানে এক অদ্ভুত আধ্যাত্বিক অনুভূতি অনুভব করলাম. কথিত আছে মহাকালের দর্শন জীবনের সব পাপ মোচন করে.


বড় গণেশ মন্দির... মহাকালের দর্শনের পর আমরা গেলাম বড় গণেশ মন্দির. মহাকাল মন্দির এর সামনেই বড় গনেশ মন্দির. এখানকার গণেশের মূর্তি টি বিশাল. এখানকার বাবা গনেশ নাকি খুব জাগ্রত . মন্দির থেকে বেরিয়ে একটি দোকানে সামান্য টিফিন করে নিলাম


কাল ভৈরবের মন্দির.... এবার আমরা গেলাম মহাকাল ভৈরব এর মন্দির দর্শন এ. মহাকাল মন্দির থেকে কালভৈরবের মন্দিরের দূরত্ব মাত্র . গাড়িতে সময় লাগলেও মাত্র 10 মিনিটের মত. পৌরাণিক রীতি অনুযায়ী বাবা মহাকালের দর্শনের পর কালভৈরব মন্দির দর্শন না করলে মহাকালের দর্শন পূর্ণ হয়না. এইখানে মহাদেবের পুজো তে সূরা নিবেদন করা হয়. আপনি চাইলে বাবার পুজো তে মদ নিবেদন করতে পারেন. মন্দির প্রাঙ্গনের পূজার সামগ্রী বিক্রি করা দোকানগুলিতে খোলাখুলি ভাবেই মদ বিক্রি হয়. এখানে পানীয় জলের যথেষ্ট সমস্যা রয়েছে, তাই সঙ্গে পানীয় জলের বোতল অবশ্যই রাখবেন.


মহর্ষি সন্দীপনি ঋষির আশ্রম... মহাকালেশ্বর মন্দির থেকে মাত্র 5 কিমি দূরে মহর্ষি  সন্দীপনি ঋষিরআশ্রম. বিশাল এলাকা জুড়ে এই আশ্রম. পুরান থেকে জানা যায় বাল্যকালে শীকৃষ্ণ, বলরাম ও সুদামা এই আশ্রম এ সন্দীপনি ঋষির কাছে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে. আশ্রমের চারপাশে রয়েছে বিশাল এক উদ্যান ও একটি গোশালা.সন্দীপনি ঋষির দ্বারা নির্মিত শিব মন্দিরটি আজও এখানে বিরাজমান.


গোমতী কুণ্ড... উজ্জয়িনীর অন্যতম পবিত্র স্থান হল এই গোমতী কুণ্ড.মহর্ষি সন্দীপনি ঋষির আশ্রম এ রয়েছে এই পবিত্র জলাশয়টি. কথিত আছে শ্রীকৃষ্ণ বাল্যকালে মহর্ষি সন্দীপনি ঋষির কাছে শিক্ষা লাভের সময় গুরুদেবের জন্য তীর  দিয়ে এই জলাশয়টি সৃষ্টি করেন. এই জলাশয় এর জলের সংস্পর্শে  নাকি সব পাপ দূর হয়. জলাশয়টি খুবই গভীর. জলাশয় এর চারপাশে রয়েছে বাধানো সিরি. জলাশয় টির পাশে রয়েছে পবিত্র গমতি শিলা. এই শিলা নাকি জলাশয় এর মধ্য থেকে পাওয়া গিয়েছিল. 


রাম ঘাট... উজ্জয়নীর পবিত্র শিপ্রা নদীর তীরে 4 বিখ্যাত ঘাটের অন্যতম সবচেয়ে প্রাচীন হল রাম ঘাট. পৌরাণিক কাহিনী থেকে জানা যায় রামচন্দ্র পিতার মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পর এখানে পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ করেছিলেন. তাই ঘাট টি রামঘাট নামে বিখ্যাত. এইরাম ঘাটের তীরে প্রতি 12 বছর অন্তর কুম্ভ মেলা বসে. লক্ষ লক্ষ মানুষ এই সময় এখানে উপস্থিত হন. পবিত্র শিপ্রা নদীর অবস্থা আজ খুবই করুন. গ্রীষ্মের শুরুতেই নদীতে জল নেই বললেই চলে. বিশাল  শিপ্রা নদী  আজ সংকীর্ণ.


কালিয়াদহ প্যালেস.... এবার আমাদের গন্তব্য কালিয়াদহ প্যালেস. উজ্জয়নী এর অন্যতম আকর্ষণ এই ঐতিহাসিক মহল. আজ থেকে প্রায় 400 বছর আগে মোগল সম্রাট নাসিরুদ্দিন শাহ এই মহলটি নির্মাণ করেছিলেন. শিপ্রা নদীর তীরে এই মহলটি নির্মিত. উজ্জয়নী রেল স্টেশন থেকে দূরত্ব মাত্র 2 কিমি. মহলটির মাটির উপরে যতটা অংশ রয়েছে, মাটির নিচেও নাকি ঠিক ততটাই রয়েছে. মহলের বিভিন্ন অংশে যাওয়ার জন্য সুরঙ্গ পথ ছিল. মহলটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যাতে শিপ্রা নদীর জল মহলের বিভিন্ন অংশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে. গ্রীষ্মকালে প্রচন্ড গরমের হাত থেকে বাঁচার জন্য নাসিরুদ্দিন শাহ শিপ্রা নদীর জলে ডুবে থাকতেন. জলে ডুবে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তি নাসিরুদ্দিন শাহ কে মৃত ভেবে স্পর্শ করলে ওই ব্যক্তির দুহাত কেটে নেওয়া হয়. মহাকবি কালিদাসের কাব্যে এই মহলের উল্লেখ আছে. এই মহলে 52 টি স্তম্ভ রয়েছে, তার জন্য একে 52কুণ্ড ও  বলা হয়ে থাকে. লোককথা অনুযায়ী জানা যায় এখানকার জলে স্নান করলে নাকি ভুত-প্রেত দূর হয়. সূর্যের প্রথম কিরণ এই মহলে প্রথম পড়ে বলে এটি সূর্য মহল নামেও পরিচিত.


জন্তর মন্তর.....  উজ্জয়িনীর বিখ্যাত টুরিস্ট স্পর্ট গুলির মধ্যে অন্যতম হলো যন্তর মন্তর. জয়পুরের মহারাজ মান সিং এটি নির্মাণ করেছিলেন. মহাকালেশ্বর থেকে যন্তর-মন্তর দূরত্ব মাত্র 2 কিমি. মহারাজ মানসিংহের জ্যোতিষশাস্ত্রের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল. তাই তিনি দিল্লি, উজ্জয়নী, বারানসি যন্তর মন্তর নির্মাণ করেছিলেন. হামক যন্তর মন্তরে বিশাল পাঁচটি যন্ত্র আছে... সম্রাট যন্ত্র, নারী বল, দিগন্ত যন্ত্র, শঙ্কু যন্ত, বৃত্তি যন্ত্র. এখানে  একটি সূর্যঘড়ি রয়েছে যার সাহায্যে নিখুঁত ভাবে আজও সময় নির্ধারণ করা হয়. ধ্রুবতারার অবস্থান কে কেন্দ্র করে এটি নির্মাণ করা হয়েছে. যন্তর মন্তর প্রবেশ করার জন্য 10 টাকার টিকিট কাটতে হয়.

কিভাবে  যাবেন... উজ্জয়িনী মধ্য ভারতের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ধার্মিক পর্যটন কেন্দ্র. দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিবছর বহু পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন. ট্রেন, বাস বা বিমানে করে অতি সহজে উজ্জয়িনী যাওয়া যায়. তবে কম খরচে  সবচেয়ে আরামদায়ক হল ট্রেন জার্নি. হাওড়া থেকে উজ্জনি যাওয়ার সরাসরি একটি ট্রেন রয়েছ শিপ্রা এক্সপ্রেস. তবে ট্রেন পাল্টে পাল্টে যাওয়া যায়.


কোথায় থাকবেন..... ঐতিহাসিক পর্যটক কেন্দ্র উজ্জয়িনী তে থাকা খাওয়ার কোনো অসুবিধা নেই. দু'একদিন হোটেল বা লজে  থেকে সমগ্র উজ্জয়িনী ঘুরে দেখা সম্ভব. বিভিন্ন বাজেটের লজ হোটেল এখানে পেয়ে যাবেন.400-500 টাকার মধ্যে হোটেল পাওয়া সম্ভব. হাতে যদি দিন সাতেক সময় থাকে তাহলে আশেপাশের বিখ্যাত স্থানগুলি ঘুরে দেখতে পারেন. কাছেই রয়েছে ইন্দোর. দূরত্ব মাত্র 55 কিমি. প্রচুর দর্শনীয় স্থান রয়েছে এখানে. ঘুরে আসতে পারেন ওংকারেশ্বর. কালাপানি জলপ্রপাতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আপনি মুগ্ধ হবেন. ইতিহাস ও ধর্মের অসাধারণ মেলবন্ধন উজ্জয়নী শহর.


অন্যান্য কয়েকটি উল্লেখযোগ্য লেখা-----


1) ইতিহাস ও ধর্মের অসাধারণ মেলবন্ধন: উজ্জয়িনী.click Here 👉https://worldvraman.blogspot.com/2022/08/ujjain.html


2) উড়িষ্যার কাশ্মীর দারিংবাড়ি....https://worldvraman.blogspot.com/2022/01/daringbadi.html


3) পাখিদের স্বর্গরাজ্য চুপির চর....https://worldvraman.blogspot.com/2021/11/chupir-char-purbasthali.html

    

  


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ