মূর্তি --একটি পাহাড়ি নদী
=====================================
নিউ জলপাইগুড়ি তে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেস খুব ভোরে আমাদের নামিয়ে দিল. স্টেশনের ওয়েটিং রুমে ফ্রেশ হয়ে স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে এলাম. সবে ডিসেম্বর মাসের শুরু কিন্তু দেশ ঠান্ডা পড়েছে. কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসে কাঁপুনি লাগছিল. আগের থেকে ছোট গাড়ি করাই ছিল, ড্রাইভার ভাই এসে আমাদের অর্থাৎ আমরা ছয় বন্ধুকে গাড়ির কাছে নিয়ে গেল. পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল আপন গতিতে. গন্তব্য মূর্তি. পাহাড়ি রাস্তার দু'পাশে গালিচার মতো সবুজ চা বাগান. চা বাগানের মেয়ে শ্রমিকরা চা পাতা পিঠে বাধা ঝুড়িতে ফেলছে. কুয়াশা মোড়া চা বাগানের দৃশ্য অসাধারণ. লোভ সামলাতে না পেরে বন্ধুরা কেউ কেউ গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম ছবি তোলার জন্য. প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আমরা মূর্তিতে এসে পৌছালাম. বনবিভাগের বনানী লজে আমাদের ঘর বুকিং করা ছিল. রুমগুলি বেশ বড় আর সুন্দর বারান্দা আছে. এই বারান্দা থেকে চারপাশের বনাঞ্চল ও মূর্তি নদীর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়.
এই বাংলোর পাশে বয়ে চলেছে মূর্তি নদী. ছোট্ট পাহাড়ি নদী. স্বচ্ছ কাঁচের মতো জল খুবই অল্প , প্রায় শুকিয়ে এসেছে. কাছেই চাপড়ামারি অভয়ারণ্য. দুপুরে গরম গরম ভাত আর মুরগির মাংস খেতে বেশ ভালোই লাগলো. খাওয়া-দাওয়ার পর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম. মূর্তি নদীর উপর নির্মিত সেতুর পেরিয়ে চাপড়ামারি অভয়ারণ্য প্রবেশপথ. গেটে কিছু সই এর জন্য আমাদের নামতে হলো. আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়াল ওয়াচ টাওয়ারের সামনে. ওয়াচ টাওয়ার থেকে চারপাশের জঙ্গল বেশ ভালই দেখা যায়. কিছু দূরে দেখতে পেলাম একটি গন্ডার কচি কচি ঘাস খেয়ে বেড়াচ্ছে. হঠাৎ দেখলাম একটি ময়ূর খাবারের সন্ধানে নেমে এল মাঠের মধ্যে কিন্তু আমাদের আওয়াজ শুনে গাছপালা আড়ালে মিলিয়ে গেল. কিছু বাইসন কে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম. আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম. অভয়ারণ্যের তরফে এক জায়গায় স্থানীয় বালক-বালিকাদের নিয়ে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল. মূর্তি নদীর ধারে বসে সেই অনুষ্ঠান দেখতে বেশ ভালই লাগছিল. পার্বত্যাঞ্চলে সন্ধ্যা খুব তাড়াতাড়ি নেমে আসে. লজে ফিরে এলাম. জঙ্গলে রাতে ঘোরাঘুরি নিরাপদ নয়. লজ কর্তৃপক্ষ রাত্রিবেলা রুটি মাংসের ব্যবস্থা করেছিলেন. খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় সামান্য আড্ডা মেরে তাড়াতাড়ি আমরা ঘুমিয়ে পরলাম.
পরেরদিন খুব ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল. ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম. সকালের আলো নদীর জঙ্গলে এক অপরূপ ক্যানভাস সৃষ্টি করেছে. আলো ফোটার সাথে সাথে মূর্তি নদীর জলের রং বদলাতে লাগলো. মূর্তি তার জলের রং বদলাতে বদলাতে তরতর করে বয়ে চলেছে.
দু'একজনকে চিপ নিয়ে নদীতে মাছ ধরতে দেখলাম. সকাল ন'টায় আমাদের সাফারির জিপ এসে হাজির . আজ আমাদের গন্তব্য গরুমারা অভয়ারণ্য. প্রবেশদ্বারে নিয়মমাফিক সই এর পর গেট খুলে গেল. যত ভিতরে ঢুকতে লাগালাম ততই জঙ্গল গভীর হতে লাগল. ছোটখাটো অনেক জীবজন্তু দেখতে পেলাম. অনেক পশু পাখির নাম ও ঠিকমতো জানিনা. ঘুরতে ঘুরতে প্রথম ওয়াচ টাওয়ারের কাছে এসে পৌছালাম. এই ওয়াচ টাওয়ার টির নাম যাত্রা প্রসাদ. একটি হাতির নামে এই নাম. ওয়াচ টাওয়ার থেকে কয়েকটা বাইসন কে দেখতে পেলাম. দ্বিতীয় ওয়াচ টাওয়ারের নাম রাইনো পয়েন্ট. গরুমারা অভয়ারণ্য থেকে গেলাম জলেশ্বর শিব মন্দির. যেতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় লাগলো. মন্দিরের ভিতরে ঢুকতে টিকিট কাটতে হয়. বিনা অনুমতিতে এখানে ছবি তোলার নিষিদ্ধ. পুরোহিত মশাই খুব ভক্তির সাথে পূজা সম্পূর্ণ করলেন. প্রসাদ খেয়ে আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম. লাটাগুড়ি তে একটি হস্তশিল্পের দোকানে নামলাম কিছু কেনাকাটার জন্য. লজে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল. রাত্রিবেলায় আমাদের ট্রেন.
কিভাবে যাবেন ---মূর্তি যাওয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামা. নিউ জলপাইগুড়ি থেকে মূর্তি মাত্র 66 কিমি দূরে. স্টেশন থেকে ছোট গাড়ি ভাড়া পাওয়া যায়. নিউ মাল জংশন থেকেও মূর্তি যাওয়া যায়. তবে সবচেয়ে ভালো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে নামা কারণ এখানে সব ট্রেন দাঁড়াই.
কোথায় থাকবেন.... ফূর্তিতে থাকার জন্য সরকারি-বেসরকারি ছোট-বড় অনেক লজ আছে. বনবিভাগের নিজস্ব বাংলো রয়েছে. তবে সেখানে থাকতে গেলে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই ভালো.
0 মন্তব্যসমূহ