নবাবের শহর মুর্শিদাবাদ
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে কজন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম নবাবের শহর মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে. একটি বুলোরো গাড়িতে 7-8 জন বন্ধু মিলে শুরু করলাম একদিনের মুর্শিদাবাদ ভ্রমণ. জানি একদিন এ পুরো মুর্শিদাবাদ ঘোরা সম্ভব নয়, তবু বেরিয়ে পড়লাম. পৌষ মাস বেশ জাঁকিয়ে শীত পড়েছে. সোয়েটার টুপি মাফলার কেও হার মানাচ্ছে. পথে একটি দাবাই ় সামান্য চা জলখাবার খেয়ে আবার আমরা যাত্রা শুরু করলাম. চারিদিকে ঘন কুয়াশা, ড্রাইভার খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিল. ভোর ছটা নাগাদ আমরা পৌঁছে গেলাম নবাবের শহরে. হাজারদুয়ারীর সামনে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করলাম. সামনের ভাগীরথী নদীর পাড়ে দেখলাম বহু মানুষ পিকনিকের জন্য জড়ো হয়েছে. হাতমুখ ধুয়ে সামনের একটা দোকানে চা বিস্কুট খেলাম. পুরাতন এই শহর. এখনকার বাড়িঘর দেখলে তা অনুমান করা যায়.
হাজার দুয়ারী প্যালেস .... আমাদের প্রথম গন্তব্য স্থান হাজারদুয়ারি প্রাসাদ. ভাগীরথী নদীর তীরে প্রায় 40 একর এলাকা নিয়ে এই বিশাল প্রাসাদ নির্মিত হয়েছে. হাজারদুয়ারি কেবল মুর্শিদাবাদের নয় সমগ্র বাংলার গর্ব. হাজারটি দরজার জন্য এটি হাজারদুয়ারি নামে পরিচিত. সুবিশাল এই নবাবী প্রাসাদ সত্যিই দেখার মতো. চোখ ফেরানো দায়. তবে এটি নবাব নির্মিত আসল প্রাসাদ নয়. আসল প্রাসাদটি ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়ে ভাগীরথীর জলে তলিয়ে গেছে. সেই প্রাসাদের অনুকরণে বর্তমান প্রাসাদটি নির্মিত হয় যা বর্তমানে একটি জাদুঘর বা সংগ্রহশালা. টিকিট কেটে পাসাদে ঢুকে পড়লাম. সিরাজদুল্লাহ তর আলি থেকে শুরু করে নবাবের ব্যবহৃত চেয়ার , ঝাড়বাতি, পোশাক , ইংরেজদের ব্যবহৃত বিভিন্ন দ্রব্য এখানে রাখা আছে. মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে পাসাদে প্রবেশ নিষিদ্ধ. বিশাল সেই প্রাসাদ ঘুরে দেখতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লেগে গেল. হাজারদুয়ারীর কাছে রয়েছে ইমামবাড়া, বাচ্চাওয়ালি তোপ, মুর্শিদাবাদ ক্লক টাওয়ার.
নিউ প্যালেস.... হাজারদুয়ারি দক্ষিণ প্রান্তে এই প্রাসাদটি অবস্থিত. নবাব ওয়াসেক আলী মির্জা নিজে থাকার জন্য এই প্রাসাদটি তৈরি করেন. এটি নতুন প্রাসাদ নামে পরিচিত. প্রাসাদটি অসাধারণ সুন্দর দেখতে. এখানে একটি কৃত্রিম পাহাড় ছিল.1867 সালের ভূমিকম্পে মূল প্রাসাদটি ভেঙে পড়ে. প্রাসাদটি উদ্ধার করা গেলেও পাহাড় টি পুনর্গঠন করা সম্ভব হয়নি.
মুর্শিদাবাদ শহর ঘুরে দেখা সবচেয়ে ভাল মাধ্যম হল ঘোড়ার গাড়ি. চুক্তি করে একটি ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলাম. ঘোড়ার গাড়ির সফর বেশ লাগছিল.
জগৎশেঠের বাড়ি.... এরপর আমাদের গন্তব্য জগৎশেঠের বাড়ি. এটি হাজারদুয়ারি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে. জগৎশেঠের বাড়ি সুবিশাল. কাঠগোলা বাগান বাড়ি ও বলা হয়ে থাকে একে. কারণ জগৎশেঠের কাঠের ব্যবসা এখানেই চলত. বহু ইংরেজ অফিসার এই বাড়িতে আসতে. এখানে এমন কিছু নিদর্শন আছে যা মানুষের মনে বিস্ময় সৃষ্টি করে. প্রাসাদ, বাগান , আদিনাথ মন্দির, মাইকেল হানজোলা মূর্তি সত্যিই দেখার মতো. জগৎশেঠের বাড়ি থেকে বাগানবাড়ি পর্যন্ত একটি বিশাল সুরঙ্গ পথ আছে যা বর্তমানে ভাগীরথীর জল ভর্তি হয়ে সম্পূর্ণ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে রয়েছে.
আজিমুন্নেসার সমাধি...... নচিপুর যাওয়ার পথে পড়ে আজিমুন্নেসার সমাধি. নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর কন্যা ছিলেন আজিমুন্নিসা বেগম. শোনা যায় ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়লে হাকিম সাহেব তাকে মানব শিশুর লিভার দিয়ে তৈরি এক বিশেষ ওষুধ খাওয়ার নিদান দেন. অত্যন্ত গোপনীয় ভাবে ওষুধ তৈরি করে বেগমকে দেয়া হতো. কিছুদিন পর বেগম সুস্থ হয়ে গেলেও মানব কলিজায় আসক্ত হয়ে পড়েন. তখন মুর্শিদকুলি খাঁ আজিমুন্নেসা বেগম কে এখানে জীবন্ত কবর দেন. যদিও এর কোন ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায়নি.
জাফরগঞ্জ প্রাসাদ.... ভাগীরথী নদীর পূর্ব দিকে নসিপুর রাজপ্রাসাদ যাওয়ার পথে পড়ে জাফরগঞ্জ প্রাসাদ. এখানেই নাকি মীরজাফর থাকতেন. নবাব আলীবর্দী খাঁ তার ভগিনী শাহখানমের জন্য এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেছিলেন. পরে তিনি হীরাঝিল প্রাসাদ এ চলে যান. বর্তমানে প্রাসাদটি ভগ্নপ্রায়. মীরজাফর বাস করার জন্য এই প্রসাদ কে আজও নেমকহারাম দেউড়ি বলা হয়.
নসিপুর রাজবাড়ী..... নসিপুর গ্রামে বিখ্যাত অত্যাচারী রাজা দেবী সিং এর নির্মিত রাজপ্রাসাদটি রয়েছে. এটি নসিপুর রাজবাড়ী নামে পরিচিত. দেবী সিং পানিপথ থেকে ব্যবসা করতে এসে এখানে এই প্রাসাদটি নির্মাণ করেন. এখানেই তাঁর দরবার হত. বর্তমান প্রাসাদটি রাজা কীর্তিচন্দ্র সিং নির্মাণ করেছিলেন 1845 সালে.
কাটরা মসজিদ... এটি একটি সমাধিস্থল. নবাব মুর্শিদকুলি খানের উদ্দেশ্যে এটি নির্মিত হয়েছিল.1724 সালে কাটরা মসজিদ নির্মিত হয়. মুর্শিদাবাদের স্থাপত্য গুলির মধ্যে অন্যতম কাটরা মসজিদ. মসজিদটি দ্বিতল বিশিষ্ট আর মসজিদে চারটি কনে চারটি মিনার আছে. মসজিদটি লাল- ইট দিয়ে তৈরি.
সিরাজউদ্দৌলার মদিনা..... এটি সিরাজউদ্দৌলার আমলে নির্মিত একমাত্র স্থাপত্য. এই মদিনার জন্য সিরাজদুল্লাহ নিজে কারবালা থেকে পবিত্র মাটি মাথায় করে এনেছিলেন. শোনা যায় সিরাজদুল্লাহ মা আমিনা বেগম প্রতিজ্ঞা করেছিলেন সিরাজদুল্লাহ নবাব হলে নিজে মদিনার পবিত্র মাটি মাথায় করে এনে এই মদিনা তৈরি করবে. কেবল মাত্র মহরম এর সময় এই মদিনার দরজা খোলা হয় বাকি সময় এটি বন্ধ থাকে.
মতিঝিল.... এবার আমাদের গন্তব্য মতিঝিল. মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত স্থান গুলির মধ্যে মতিঝিল অন্যতম.1750 সালে ঘসেটি বেগমের স্বামী নবাব নওয়াজের মোহাম্মদ খান অশ্বক্ষুরাকৃতি মতিঝিল ও তার পারে শাহী দালান নামে একটি প্রাসাদ তৈরি করেন . প্রাসাদটি বিনষ্ট হয়ে গেলেও হদ ডি এখনও রয়েছে. এই শাহী দালানে পলাশী যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল বলে ইতিহাসবিদদের অনুমান. মতিঝিলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই দেখার মতো.
কিভাবে যাবেন... মুর্শিদাবাদ যাওয়ার সবচেয়ে আরামদায়ক মাধ্যম হলো ট্রেন. হাওড়া শিয়ালদা টেশন থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার প্রচুর ট্রেন ছাড়ে. লালগোলা এক্সপ্রেস, হাজারদুয়ারি এক্সপ্রেস, ভাগিরতি এক্সপ্রেস প্রকৃতির ট্রেনে সহজেই মুর্শিদাবাদ যাওয়া যায়. এছাড়া পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটি জেলা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার প্রচুর বাস ছাড়ে. প্রাইভেট গাড়িতে ও আপনি অতি সহজেই একদিনের জন্যও মুর্শিদাবাদ ঘুরে আসতে পারেন.
কোথায় থাকবেন..... মুর্শিদাবাদ একটি প্রাচীন শহর হলেও পর্যটন শিল্পের উন্নতির সাথে সাথে এখানকার পরিকাঠামোর যথেষ্ট উন্নতি ঘটেছে. এখানে থাকার জন্য ছোট-বড় অনেক লজ রয়েছে. এছাড়া রয়েছে সরকারি টুরিস্ট লজ. সারাবছরই মুর্শিদাবাদে প্রচুর পর্যটক আসেন তাই মুর্শিদাবাদ যাওয়ার আগে হোটেল বুক করে যাওয়াই ভালো.
1 মন্তব্যসমূহ
Murshidabad khub bhalo turist spot.sab information e Post e tule dara hoyeche.valo laglo.
উত্তরমুছুন