মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর
যদি আপনি ঐতিহাসিক শহর ঘুরতে ভালোবাসেন তবে অবশ্যই আপনাকে একবার বিষ্ণুপুরে আসতেই হবে. এখানকার পরোতে পরোতে ইতিহাসের ছোঁয়া. ইতিহাস ও স্থাপত্য শিল্পের এমন মেলবন্ধন আপনি আর কোথাও দেখতে পাবেন না. অত্যন্ত প্রাচীন ইতিহাস সমৃদ্ধ এই শহর আপনাকে মুগ্ধ করবেই . লালমাটির এই শহর তার অতীত ইতিহাস আপনাকে জানানোর জন্য অধীর ভাবে অপেক্ষা করছে. শুধু কি ইতিহাস, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও আপনাকে মুগ্ধ করবে. রাজাদের রাজধানী এই বিষ্ণুপুরে এক সময় বৈষ্ণব ধর্মের জোয়ার বয়ে গিয়েছিল. রাজারা নিজেদের ঈশ্বর সেবায় নিয়োজিত করেছিলেন. এখানকার বিখ্যাত বিখ্যাত মন্দির গুলি তারই ফল. মন্দির, বান্দ ও জঙ্গল বেষ্টিত এই ছোট্ট শহরটি দিনদিন ভ্রমণপিপাসু মানুষের কাছে পছন্দের স্থান হয়ে উঠেছে. বিষ্ণুপুরের কিছু দর্শনীয় স্থানের বিবরণ এখানে তুলে ধরলাম. বিষ্ণুপুর ঘুরতে গেলে এই তথ্যগুলি আপনাদের কাজে লাগবে.
রাস মঞ্চ..(Ras Mancha) বিষ্ণুপুরের স্থাপত্য গুলির মধ্যে অন্যতম রাস মঞ্চ. শহরের মধ্যভাগে এই নিদর্শনটি অবস্থিত. মল্ল রাজ বীর হাম্বীর আনুমানিক 1600 খ্রিস্টাব্দে রাস মঞ্চ নির্মাণ করেছিলেন. রাস উৎসবের সময় শহরের সমস্ত রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ এখানে আনা হতো জনসাধারণের দর্শনের জন্য.1600-1932 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এখানে রাস উৎসব হয়. বর্তমানে এটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে. ্ টিকিট কেটে রাসমঞ্চ এর ভিতরে প্রবেশ করতে হয়. ভিতরে সজ্জিত ফুলের বাগান. পিরামিড আকৃতির স্থাপত্যটি ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি. এখানে একশো আটটি দরজা ও চল্লিশটি স্তম্ভ রয়েছে. মন্দির গাত্তে শিল্প কার্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই.
গুমঘর (Gumghar) --- রাস মঞ্চ থেকে সামান্য এগোলে দেখতে পাবেন প্রাচীন একটি সৌধ. গুমঘর নামে পরিচিত. সুবিশাল এই স্থাপত্যটি অবাক হয়ে দেখতে হয়. দরজা-জানলা বিহীন এই সৌধটি প্রায় চার তলার সমান উঁচু. এই সৌধ প্রায় 300 বছরেরও বেশি প্রাচীন. অনেকের মতে মল্ল রাজাদের আমলে অপরাধীদের এখানে ফেলে দেয়া হতো. আবার অনেকের মতে এটি রাজবাড়ীর জলের ট্যাঙ্ক ছিল.
মৃন্ময়ী মন্দির (Mrinmoyee Mandir) --- গুমঘর থেকে সামান্য এগোলেই মল্ল রাজাদের কুল দেবী মা মৃন্ময়ী মন্দির. আনুমানিক 600 খ্রিস্টাব্দে মল্ল রাজ জগৎমল্ল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন. আগেই মল্ল রাজাদের রাজধানী ছিল জয়পুরে. বিষ্ণুপুরে ছিল গভীর জঙ্গল. এলাকাটি বন বিষ্ণুপুর নামে পরিচিত ছিল. জগৎমল্ল এই জঙ্গলে শিকার করতে এসে দেখেন এক শিকারী শুকন একটি বকের উপর বারবার ঝাঁপিয়ে পড়ছে আর এক অলৌকিক শক্তি বলে বক টি রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে. রাজা জগৎমল্ল ওই স্থানে অলৌকিক মাহাত্ম্য অনুভব করেন. ওই স্থানের মাটি সরিয়ে তিনি একটি দেবী মুক্তির মুখ দেখতে পান. ওই দেবী মুক্তি নিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদের ফিরে যান. রাত্রিবেলা রাজা দেবীর স্বপ্নাদেশ পেলে বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণ করেন. রাজপ্রাসাদ বানানো হয় মন্দিরের পাশে. বর্তমানে যা ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে. প্রতিবছর দুর্গ পুজোর সময় প্রাচীন রীতি মেনে মৃন্ময়ী মায়ের পুজো করা হয়. অষ্টমীর দিন সন্ধি পূজার সময় কামান দাগা হয়. আজও এই রীতি চলে আসছে.
মদনমোহন মন্দির (Madan Mohan Mandir) -- বিষ্ণুপুরের মন্দির গুলির মধ্যে অন্যতম মদনমোহন মন্দির. এটি একটি বিষ্ণুমন্দির.মল্ল রাজা দুর্জন সিংহ 1694 খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন. মন্দিরটি পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি .মন্দিরের কারুকার্য সত্যিই দেখার মতো.
গড় দরজা (Gar Darwaza) --- মৃন্ময়ী মন্দির থেকে একটু এগোলেই দেখতে পাবেন গড়দরজা. ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে তৈরি. এটি নাকি রাজপ্রাসাদের প্রবেশপথ. এখানে সশস্ত্র প্রহরী পাহারা দিত. শত্রু আক্রমণের সময় দুর্গার মুখ বন্ধ করে দেয়া হত. সামনে রয়েছে আরেকটি সৌধ.... ছোট গড় দরজা.
জোড়বাংলা মন্দির ( Jor Bangla Mandir) -- 1655 খ্রিস্টাব্দে মল্ল রাজা রাজনাথ সিং জোড়বাংলা মন্দির নির্মাণ করেন. বিষ্ণুপুরের মন্দির গুলির মধ্যে জোড়বাংলা অন্যতম. দোচালা বিশিষ্ট এই সৌধটি ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে নির্মিত. মন্দির গাহে ধ্রুপদী টেরাকোটার শিল্পকলা নজর কাড়ে. বর্তমানে এটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে. টিকিট কেটে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়.
শ্যামরাই মন্দির(Shymrai Mandir) ---- 1643 খ্রিস্টাব্দে রঘুনাথ সিং শ্যামরাই মন্দির নির্মাণ করেন. একটি স্তম্ভাকার চতুষ্কোণ ভিতের উপর এ মন্দিরটি নির্মিত. মন্দিরটি গায়ের ভাস্কর্য অসাধারণ. রামায়ণ-মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে. গান্ধার শিল্পের নিদর্শন এই মন্দিরে লক্ষ্য করা যায়. এই মন্দিরে পাঁচটি চূড়া থাকার জন্য পাঁচচূড়া মন্দির একে বলা হয়. বর্তমানে এই মন্দিরটিও ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনে.
লালবাধ ( Lalbandh) --- 1658 সালে মল্ল রাজ বীরসিংহ লাল্ বাঁধ সহ শহরের বুকে সাতটি বিশাল বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন. শহরকে শত্রু আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করতে ও শহরবাসীর জল কষ্ট মেটাতে বাঁধ গুলি নির্মাণ করা হয়.বাঁধ গুলির মধ্যে লালবাঁধ অন্যতম. লালবাঁধ এর সাথে রাজা রঘুনাথ সিংহ ও লাল বাই এর প্রেম কাহিনী ইতিহাস জড়িত . কথিত আছে এই বাঁধে নাকি মহারানী নির্দেশে লাল বাই কে ডুবিয়ে মারা হয়. সে জন্য এটি লালবাঁধ নামে পরিচিত. গভীর রাতে লাল বাই এর আর্তনাদ নাকি আজ ও শোনা যায়. পূর্ণিমার রাতে চাঁদের আলোয় এখানকার সৌন্দর্য দেখার মত. বর্তমানে লালবাঁধ এ নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়েছে. লালবাঁধ পারে বিশ্রামের জন্য ছোট ছোট ঘর নির্মান করা আছে. সেখানে বসে আপনি বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন. শীতকালে প্রচুর পরিযায়ী পাখি আসে. বিভিন্ন পাখ-পাখালির কলরব আপনার ক ান কে সিদ্ধ করবে
.ছিন্নমস্তা মন্দির(chinnomasta Mandir)-লালবাঁধ ঘুরে কলেজ রোড ধরে চলে আসুন ছিন্নমস্তা মন্দির. মেদিনীপুরের স্বর্ণ ব্যবসায়ী কৃষ্ণমোহন গুই দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন. দেবী মূর্তিটি রাজস্থান থেকে আনা. প্রাচীন রীতি মেনে মন্দিরে আজও পুজো হয়ে আসছে. প্রতিদিন নিত্য পূজার পাশাপাশি অমাবস্যা বিশেষ পূজা অর্চনা ব্যবস্থা করা হয় মন্দিরে. মন্দিরের পাশে প্রচুর টেরাকোটা দোকান আছে.
দলমাদল কামান (Dalmadal Kaman) --- ছিন্নমস্তা মন্দির এর কাছে রয়েছে দলমাদল কামান. রুপোর বিশালাকৃতি কামানটি বসানো আছে. কামান টির দৈর্ঘ্য 12 ফুট 5 ইঞ্চি আর পরিধি 11 ইঞ্চি. কমানটি তৈরি করেছিলেন জগন্নাথ কর্মকার. বিজাপুরের প্রসিদ্ধ "মালিক - ই- ময়দান" কামান এর অনুকরণে দলমাদল কামান টি তৈরি করা হয়েছে. কমান্ডটি তৈরি করতে তৎকালীন সময়ে এক লক্ষ 25 হাজার টাকা খরচ হয়েছিল. কথিত আছে বিখ্যাত মারাঠা সর্দার ভাস্কর পন্ডিত এখন করলে রাজধানী রক্ষা করার জন্য মদনমোহন কামান দেগে শত্রুর আক্রমণ প্রতিরোধ করেছিলেন.
জোড় মন্দির ( Jor Mandir) ---ছিন্নমস্তা মন্দির এর খুব সামনে রয়েছে জোড় মন্দির . এটি আসলে এক রত্না বিশিষ্ট তিনটি মন্দিরের সমষ্টি.1726 খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণ সিং এই মন্দির গুলি নির্মাণ করেছিলেন. ল ্যাটেলাইট পাথর দিয়ে এই মন্দির গুলি নির্মিত মন্দির গায়ের শিল্প কার্য অপরূপ. মন্দির তিনটি প্রায় একই রকম দেখতে. দুটি মন্দির বড় আরেকটি মন্দির ছোট. বর্তমানে বিষ্ণুপুর প্রশাসনের উদ্যোগে জোড় মন্দিরের সামনে প্রতি শনিবার পৌষ মেলার আদলে পোড়ামাটির হাট বসে. টেরাকোটার বিভিন্ন সামগ্রী নিয়ে বসে দোকানিরা. আর থাকে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান. মন্দির ঘুরতে ঘুরতে এমন সংস্কৃতি অনুষ্ঠান দেখতে পেলে কার না ভালো লাগে.
লালগড় প্রকৃতি উদ্যান ( Lalghar Natural Park) --ছিন্নমস্তা মন্দির থেকে বেশ কিছুটা দূরে লাল বাঁধের পাড়ে গড়ে উঠেছে লালগড় প্রকৃতি উদ্যান. আগে এই অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ছিল. কয়েক বছর আগে মল্ল রাজাদের প্রাচীন একটি ইঁদারার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়. এই বিশালাকৃতি ইঁদারা কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পার্ক. শীতকালের এলে প্রচুর মরসুমি ফুলের সমাবেশ দেখতে পাবেন. রয়েছে শিশুদের মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা. আর আছে একটি ওয়াচ টাওয়ার. সেখান থেকে চারপাশের জঙ্গল খুব সুন্দর দেখা যায়.
কিভাবে যাবেন... ট্রেন পথে কলকাতা থেকে বিষ্ণুপুর দূরত্ব মাত্র 200 কিমি. রূপসী বাংলা এক্সপ্রেস, পুরুলিয়া এক্সপ্রেস, শালিমার বা যে কোন লোকাল ট্রেনে বিষ্ণুপুর আশা যায়. বিষ্ণুপুর থেকে আপনি জয়রামবাটি, কামারপুকুর, গনগনি ও ঘুরে আসতে পারেন. এছাড়া ধর্মতলা থেকে বিষ্ণুপুর আসার প্রচুর বাস পাওয়া যায়.
কোথায় থাকবেন ---- বিষ্ণুপুর একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক শহর. প্রতিবছর প্রচুর পর্যটক এখানে ঘুরতে আসেন. এখানে থাকার জন্য ছোট-বড় অনেক লজ ও হোটেল আছে. এছাড়া আছে সরকারি টুরিস্ট লজ পৌরসভা পরিচালিত ডরমেটরি. ডিসেম্বর জানুয়ারি মাসে এখানে প্রচুর টুরিস্ট আছে তাই এই সময় বিষ্ণুপুর ঘুরতে এলে আগে থেকে হোটেল বুক করে আসবেন.
( সিদ্ধেশ্বর পাল)
1 মন্তব্যসমূহ
Khub Sundar post.pore khub bhalo laglo.
উত্তরমুছুন