একদিনে ঘুরে আসুন মাইথন ও কল্যাণেশ্বরী মন্দির
প্রতিবছর শীতকাল এলেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়ি ভ্রমণ এর নেশায়. কখনো বা কাছেপিঠে কখনো বা দূরে কোথাও দু এক দিনের জন্য কর্মব্যস্ত জীবন থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে প্রকৃতির সাথে নিজেদের আত্মস্থ করে ফেলি. অজানা অদেখা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেন আমাদের চুম্বকের মত আকর্ষণ করে.
করানোর জন্য বেশ কয়েক মাস সকলেই গৃহবন্দী. ঘরের চার দেয়ালে আটকে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম. শীতের শুরুতে করোনার প্রভাব বেশ কিছুটা কমতে ঠিক করলাম এক দিনের জন্য কোথাও ঘুরে আসবো. ঠিক হলো মা কল্যানেশ্বরী ও মাইথন ড্যাম যাবো. মন্দিরে পুজো দিয়ে ঘোরাঘুরি করে রাতের মধ্যে বাড়িতে আসবো. এবার রান্নাবান্নার কোন পরিকল্পনা করলাম না. হোটেলেই খাওয়ার দাওয়া করব বলে ঠিক করলাম.
জানুয়ারি মাসের প্রথম শনিবার একটি বুলেরো গাড়িতে 6-7 জন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম মা কল্যানেশ্বরী উদ্দেশ্যে. গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে প্রায় রাত বারোটা বেজে গেল. কিছু দূর যাওয়ার পর রাস্তার ধারে একটি লাইন হোটেলে গাড়ি দাঁড় করালাম. হালকা করে একটু চা খেলাম. প্রচণ্ড ঠান্ডায় হাত পা যেন জড়োসড়ো হয়ে আসছে. আরো কয়েকটা বাস দেখলাম হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে. তারা মেদিনীপুর থেকে আসছেন , যাবেন মাইথন. একটি কোচিং সেন্টারের কিছু ছাত্র ছাত্রী ও যাচ্ছে. যাইহোক লাইন হোটেলে অল্প সময় কাটিয়ে আবার গাড়ি ছাড়লাম.
আসানসোল পেরিয়ে যখন মাইথন প্রবেশ করলাম তখন ভোর চারটা. ঘন কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন. কয়েকজন কে দেখলাম সাইকেলে করে কয়লা নিয়ে যাচ্ছে. এক একজনের সাইকেলে প্রায় 1-2 টন করে কয়লা. এদের জীবন সংগ্রামের দৃশ্য দেখে আশ্চর্য হতে হয়. আস্তে আস্তে আমরা মাইথন ড্যাম এ উপস্থিত হলাম. মাইথন শব্দের উৎপত্তি মায়ের স্থান থেকে. বরাকর ও দামোদর নদীর মিলনস্থলে তৈরি হয়েছে মাইথন ড্যাম.1943 সালে মাইথন ড্যাম নির্মাণ করা হয়. আরো অনেকেই দেখলাম পিকনিক করতে এসেছে. আগেও কয়েকবার মাইথন এসেছি তবে এবার বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগলো. করোনার ভয়ে অনেকে বাড়ির বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না.
ফ্রেশ হয়ে একটু চা খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম . প্রচন্ড ঠান্ডায় গরম গরম চা বেশ ভালই লাগছিল. এরপর গেলাম মাইথন ড্যাম এর ধারে. সূর্যের আলোয় সোনার মত চিকচিক করছে ড্যাম এর জল. মা কল্যানেশ্বরী মন্দিরের পুজো দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল. মাইথন ড্যাম এর জলে স্নান সেরে ফেললাম. ড্যাম এর জল এত ঠান্ডা যে হাত পা অবশ হয়ে আসছিল. সকাল সকাল পুজোর লাইনে না দাঁড়ালে পুজো দিতে অনেক দেরি হয়ে যাবে. একই শীতকাল পর্যটনের সময় তার উপর রবিবার. ফলে কল্যানেশ্বরী মন্দিরের ভিড় হয় স্বাভাবিক. মাইথন ড্যাম থেকে কিছুটা দূরে মন্দির. অন্যান্য কালীমন্দিরের মতো এখানেও সাধ্যমত ডালা কিনে মায়ের পুজো দিলাম. মা কল্যানেশ্বরী খুবই জাগ্রত. দূরদূরান্ত থেকে মানুষ এখানে পুজো দিতে আসেন. প্রসাদ গ্রহণের পর সামনের একটি হোটেলে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম. এরপর সাইটসিন দেখতে বেরিয়ে পড়লাম. নিজেদের গাড়ি থাকায় আমাদের কোনো অসুবিধে হলো না. প্রথমে গেলাম খোলামুখ কয়লা খনি দেখতে. খোলামুখ খনির দেখে আশ্চর্য হতে হয়. এতক্ষণ গাড়ি চালিয়ে যে রাস্তার দিয়ে আমরা এলাম তার নিচে ও খনি রয়েছে. অনেক জায়গায় কয়লা তোলার ফলে নিচের অংশ ফাঁকা. যে কোন সময় ধস নামতে পারে. ভাবলেই মনটা কেমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে. এরপর গেলাম মুক্তাইচন্ডী মন্দির. পাহাড়ের উপরে মন্দির তাই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হলো. দেবী মূর্তি প্রস্তর নির্মিত. প্রায় এক ফুট লম্বা 6 টি ঘোড়ায় টানা কারুকার্য করা রথের উপর দেবী বিরাজমান. স্থানীয় মানুষের মতে সতী মায়ের অলংকারের একটি মুক্ত এখানে পড়েছিল তাই মুক্তাইচন্ডী নাম হয়েছে. দেবী এখানে দেবী দুর্গা রূপে পূজিত হন. মাঘী পূর্ণিমার দিন এখানে সাত দিনব্যাপী বিশাল মেলা হয়.
আবার ড্যাম এ ফিরে এলাম. এবার বর্ষায় ভালো বৃষ্টি হয় ড্যাম কানায় কানায় পূর্ণ. একটি নৌকা চুক্তি করে নৌ ভ্রমণে বেরিয়ে পরলাম. নৌকায় করে ঘুরতে বেশ ভালই লাগছিল. ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে মন প্রাণ যেন জুড়িয়ে আসছিল. জলাধার এর মাঝে কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ আছে. একটি দ্বীপ এ গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালাম. দেখতে দেখতে কখন যে আড়াইটা বেজে গেছে বুঝতেই পারিনি. ড্যামের ধারে কয়েকটা স্থায়ী খাবারে দোকান আছে. মধ্যাহ্নভোজন এর জন্য সেখানে গেলাম. বিকেল চারটে নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে. বাড়ি পৌঁছতে প্রায় রাত্রি আটটা বেজে গেল.
কি ভাবে যাবেন.... ট্রেনে করে অতি সহজেই মাইথন যাওয়া যায়. হাওড়া শিয়ালদা থেকে আসানসোলগামী যে কোন ট্রেন ধরতে পারেন. এখান থেকে বাস বা ভাড়া গাড়ি করে মাইথন. সারাদিন ঘোরাঘুরি করে একদিনের মধ্যে আপনি বাড়ি ফিরতে পারবেন.
কোথায় থাকবেন.... কাছেই রয়েছে মাইথন টুরিস্ট লজ. এখানে এসি নন এসি দু ধরণেরই রুম পাওয়া যায় . খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা আছে. এছাড়া রয়েছে বেসরকারি অনেক ছোট বড় হোটেল.
0 মন্তব্যসমূহ