মুকুটমণিপুর
(Mukutmanipur)
শীতকাল মানেই চারিদিকে মেলা আর পিকনিকের আনন্দে মাতামাতি. উত্তরা বাতাসের আগমনের সাথে সাথে ভ্রমণপিপাসু বাঙ্গালীদের মন ছুটে যায় দূরের কোনো অজানা দেশে. শীতকালে ছুটি পেলেই আমরা বেরিয়ে পড়ি কোন অজানা স্থানের উদ্দেশ্যে. এবছর বড়দিনের ছুটিতে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির খুবই কাছে অথচ অসাধারণ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত মুকুটমনিপুর এর উদ্দেশ্য. বাঁকুড়ার সীমানায় অবস্থিত মুকুটমণিপুর আজ পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ এর কেন্দ্রবিন্দু. বিষ্ণুপুর থেকে মুকুটমনিপুর এর দূরত্ব বেশি নয়. কজন বন্ধু মিলে বুলেরো গাড়ি তে বেরিয়ে পড়লাম. খানাপিনার সাথে হবে হই হুল্লোর ও প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করা. ওখানে পিকনিক করার জন্য যাবতীয় জিনিসপত্র সাথে নিয়েছি. সাথে নিয়েছি একজন রাঁধুনিও. ডিসেম্বর মাসের শেষ দিকে জাঁকিয়ে শীত পড়েছে. চারিপাশ কুয়াশায় মোড়া. ঠান্ডায় রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা ,লোকজন নেই বললেই চলে. কিছু দূর গিয়ে রাস্তার ধরে একটি চায়ের দোকানে সাময়িক বিরতি নিলাম. গরম গরম চপ এর সাথে চা পান করে আবার যাত্রা শুরু করলাম. মুকুটমণিপুর পৌঁছতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো. কর্মব্যস্ত জীবন ও মোবাইল নির্ভর জীবন থেকে সাময়িক মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রকৃতির এমন লাবণ্যময় স্থানে কিছুটা সময় কাটানো সত্যিই অসাধারণ. ড্যামের কাছাকাছি একটি পিকনিক স্পটে আমরা রান্নাবান্না ব্যবস্থা করলাম. আরো অনেকে সেখানে জড়ো হয়েছেন. প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য.
কংসাবতী বাঁধ (Kagsabati Dam) ... প্রথমে আমরা গেলাম কংসাবতী বাঁধ দেখতে. এটি ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম মাটির বাঁধ. বাঁধটি মুকুটের মতো পাহাড়ের সারি দিয়ে ঘেরা. মনোময় প্রাকৃতি যেন এখানে ফিসফিস করে কথা বলে . 11 কিমি দৈর্ঘ্যের এই বাঁধটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই মনমুগ্ধকর. পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে কংসাবতী নদীর উপরে এই বাঁধটি তৈরি করা হয়. পুরুলিয়া ,বাঁকুড়া ও মেদিনীপুরের কৃষিকার্যে জলসেচের সুবিধার জন্য এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল. সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের আলোয় বাঁধের জল লাল আভায় রঙিন হয়ে ওঠে. ধারে পাহাড়ের বুকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য মনোরম. বাঁধে নৌ ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে. চাইলে নৌকায় করে মোহনা ঘুরে আসা যায়. বিকাল বেলায় পড়ন্ত সূর্যের আলোয় নৌ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা এক কথায় অসাধারণ. বাঁধের রাস্তার মুখে কিছু টেরাকোটার দোকান আছে. বাঁধের উপরে রাস্তাটি খুব সুন্দর করে আলপনা আঁকা আছে.
পরেশনাথ শিব মন্দির(Pareshnath Mandir) ... এরপর আমরা গেলাম পরেশনাথ মন্দির দেখতে. মুকুটমণিপুর বাঁধের আশেপাশে অনেক গুলি দর্শনীয় স্থান রয়েছে. পরেশনাথ মন্দির তাদের মধ্যে অন্যতম. মুকুটমণিপুর এলে অবশ্যই এখানে ঘুরে আসতে পারেন. কংসাবতী বাঁধ থেকে পরেশনাথ মন্দির মাত্র 6 কিমি দূরে. পরেশনাথ পাহাড়ের উপর এই প্রাচীন মন্দির টি রয়েছে. স্থানীয় মানুষের কাছে এটি খুবই পবিত্র স্থান. বাঁধ নির্মাণের সময় শিব মূর্তি টি পাওয়া গিয়েছিল. মন্দিরটি জৈন স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন. এখানে শিব ও জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথের মূর্তি রয়েছে. এছাড়াও এখানে অনেকগুলি জৈন দেবতাদের মূর্তি রয়েছে.
বন পাকুরিয়া হরিণ পার্ক( Deer Park) ... সবুজ ঘন বনানীর মধ্যে সুন্দর সুন্দর হলুদ বর্ণের হরিণদের বিচরন দেখতে কার না ভালো লাগে. এর জন্য আপনাকে আসতে হবে হরিণ পার্কে. নৌকায় করে নদী পেরিয়ে আরো কিছুটা পথ পেরিয়ে গেলে বন পাকুরিয়া হরিণ পার্ক. শাল ,সেগুন, পলাশ গাছে ভর্তি ছোট্ট সবুজ দ্বীপ পাকুরিয়া. এখানে রয়েছে কমবেশি 100 হরিণ. এই হরিণদের দেখে পর্যটকরা আনন্দ পান. দ্বীপটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই উপভোগ্য. এখানকার গাছ-গাছালিতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি বাস করে. তাদের ক লবরে চারিপাশ মুখরিত হয়ে ওঠে.
মুসাফিরানা ভিউ পয়েন্ট ( Mushafirana View Point) ... কংসাবতী বাঁধ এর অন্য পাশে রয়েছে মুসাফিরানা ভিউ পয়েন্ট. নৌকায় করে অতি সহজেই এখানে আশা যায়. এখান থেকে সমগ্র বাঁধের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়. বিশ্রাম নেয়ার জন্য রয়েছে সারি সারি সিমেন্টের ছাতা. তার নিচে বসে আপনি বাঁধের জলে সূর্যাস্তের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন.
অম্বিকা মায়ের মন্দির (Ambika Mandir) ... কংসাবতী বাঁধ থেকে মাত্র 3 কিমি দূরে রয়েছে অম্বিকা মায়ের মন্দির. অতি প্রাচীন এই মন্দির. দেবী দুর্গা এখানে অম্বিকা রূপে পূজিত হন. মন্দিরের কাছে রয়েছে রাজবাড়ী. তবে রাজবাড়ী আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে. কিছুই অবশিষ্ট নেই.
কখন যাবেন ( When To Go) ... শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা ,শরৎ ,হেমন্ত যে কোন ঋতুতে আপনি মুকুটমণিপুর যেতে পারেন. তবে শীতকালে মুকুটমণিপুর যাওয়া সবচেয়ে ভালো. এই সময় প্রচুর টুরিষ্ট আছেন. জানুয়ারি মাসে এলে উপভোগ করতে পারবেন মুকুটমণিপুর উৎসব. ঘোরার সাথে সাথে একটু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দর্শন মন্দ কি?
কিভাবে যাবেন (How To Go) ... মুকুটমণিপুর যেতে হলে আপনাকে রূপসী বাংলা, শালিমার, আরণ্যক বা যে কোন ট্রেনে নামতে হবে বাঁকুড়া স্টেশনে. এখান থেকে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে মুকুটমণিপুর. বাঁকুড়া থেকে মুকুটমনিপুর মাত্র 45 কিমি. বাসে করেও মুকুটমনিপুর যাওয়া যায়. ধর্মতলা থেকে বাঁকুড়া শহর যাবার প্রচুর বাস ছাড়ে. তারপর বাঁকুড়া থেকে বাসে বা ভাড়া গাড়িতে খাতড়া. খাতড়া থেকে মুকুটমনিপুর সামনে.
কোথায় থাকবেন ( Where To Stay) .... বর্তমানে মুকুটমণিপুর একটি জনপ্রিয় টুরিস্ট স্পর্ট. সারা বছরই পর্যটকদের ভিড় এখানে লেগেই থাকে. তবে শীতের মরসুমে পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়. এখানে থাকার জন্য প্রচুর ছোট-বড় সরকারি- বেসরকারি লজ -হোটেল আছে. আম্রপলি , সোনাঝুরি, হোটেল মালঞ্চ, হোটেল গ্রীন পার্ক এখানকার নাম করা হোটেল.
0 মন্তব্যসমূহ